Change Language

মুক্ত আলোচনায় বরেণ্য অভিনয়শিল্পী দিলারা জামান ও আবুল হায়াত—'গ্রহণ করতে হবে কেবল ভালোটাই'

প্রকাশিত: ২৬ মে ২০২০

০৪ নভেম্বর ২০১৯ মুক্ত আলোচনার ৯৪ তম পর্বে প্রধান অতিথি ছিলেন গুণী অভিনেত্রী দিলারা জামান। এবারের পর্বে সঞ্চালনা ও সভাপতিত্ব করেন নাট্যজন, নির্মাতা ও লেখক আবুল হায়াত।

দিলারা জামান

১৯৪৩ সালের ১৯ জুন পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে জন্মগ্রহণ করেন দিলারা জামান। মা মরহুমা সিতারা বেগম। বাবা মরহুম ইঞ্জিনিয়ার রফিকুদ্দিন আহমেদ। বাবার চাকরিসূত্রে দেশভাগের পর তার পরিবার পাড়ি জমায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের যশোরে। যশোরের ষষ্ঠীতলায় তার শৈশব কাটে। ঝড়ের দিনে আম কুড়ানো, প্রতিবেশীদের গাছের পেয়ারা পেড়ে খাওয়া, ট্রেনের শব্দ পেলে দৌঁড়ে রেলস্টেশনে চলে যাওয়া—এ দুরন্তপনার জন্যে এলাকায় শিশু দিলারা পরিচিত ছিলেন ‘বাতাসির মা’ বলে ।

যশোর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে তার শিক্ষাজীবন শুরু। এরপর ১৯৫২ সালে ঢাকার বাংলাবাজার সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন দিলারা জামান। তারপর ইডেন মহিলা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যয়নের সুযোগ পান তিনি। পরবর্তীতে বিএড, এমএড ডিগ্রি অর্জন করেছেন তিনি।

স্কুলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অভিনয় করতেন তিনি। ষাটের দশকে আধুনিক নাটকের অগ্রপথিক নাট্যগুরু নুরুল মোমেনের সান্নিধ্য লাভ করেন কলেজ পড়ুয়া দিলারা জামান। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় শহিদ বুদ্ধিজীবী ড. মুনীর চৌধুরী, প্রয়াত ড. নিলীমা ইব্রাহীম, প্রয়াত ড. মনিরুজ্জামান ও বাংলা ভাষার প্রধানতম ধ্বনিবিজ্ঞানী প্রয়াত ড. আব্দুল হাই, প্রয়াত কবি হাবীবুর রহমান, প্রয়াত কবি আহসান হাবীব, ড. আনিসুজ্জামান-এর স্নেহধন্য ছিলেন তিনি। এ গুনীব্যক্তিদের সংস্পর্শে এসে দিলারা জামানের দেশপ্রেমসহ নাটক, অভিনয়, সাহিত্যের প্রতি জন্ম নেয় প্রগাঢ় ভালোবাসা।

১৯৬২ সালে ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহনের মধ্য দিয়ে তার বাম রাজনীতির প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি।

সত্তরের দশকে ঢাকার শেরে বাংলা স্কুলে শিক্ষকতায় যোগদান করে দিলারা জামানের কর্মজীবন শুরু। পরবর্তীতে তিনি মেহেরুন নেসা স্কুল, বিএএফ শাহীন স্কুল শিক্ষক ছিলেন। ২০০০ সালে ভিকারুননিসা নূন স্কুল থেকে অবসরগ্রহণ করেন তিনি।

কর্মজীবনেও তিনি অভিনয়ের সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত ছিলেন। দেশে টেলিভিশন আসার আগে রেডিও-তে নাটকের পাশাপাশি ‘অরিন্দম নাট্যগোষ্ঠির’ সাথে যুক্ত ছিলেন তিনি। সে-সময় শিল্পকলার নাট্যোৎসবে ভিয়েতনাম যুদ্ধের পেক্ষাপটে ব্রেখটারের লেখা মা মঞ্চনাটকে অভিনয়ের জন্যে তিনি বিশেষভাবে প্রশংসিত হন। ১৯৬৫ সালে সরাসরি সম্প্রচারিত ত্রিধারা নাটকে অভিনয় করার মধ্য দিয়ে দিলারা জাহানের টেলিভিশনে পদার্পণ। প্রায় পাঁচ দশক অভিনয়ের প্রতি ভালবাসা ও এক্ষেত্রে সহজাত পারদর্শিতার ফলে পরবর্তীতে মঞ্চ ও টিভি মিলিয়ে সহস্রাধিক নাটকে অভিনয় করেন তিনি।

মঞ্চ ও টেলিভিশনের পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে বড় পর্দায়ও দেখা গেছে তার স্বচ্ছন্দ পদচারণা। বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ও পরিচালক হুমায়ুন আহমেদের আগুনের পরশমণি-এ অভিনয়ের মাধ্যমে তার চলচ্চিত্রে আগমন। এরপর ব্যাচেলর, মেইড ইন বাংলাদেশ, চন্দ্রগ্রহণ, মনপুরা-সহ আলোচিত ও ভিন্নধর্মী নানা চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয় করেন। চন্দ্রগ্রহণ চলচ্চিত্রে ‘ময়না মাসি’ চরিত্রে অভিনয়ের অনবদ্য পারদর্শিতার জন্যে তাকে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০১০-এ ভূষিত করা হয়।

অভিনয়ের পাশাপাশি লেখালেখির জগতেও দিলারা জাহানের বিচরণ হয়েছে। কলেজ জীবনে তিনি ছিলেন সাহিত্য সম্পাদিকা। তখন থেকেই তার লেখা গল্প কবিতা দৈনিক আজাদসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হতো। তার প্রথম কবিতা ১৯৫৮ সালে কচি-কাঁচার আসরে ছাপা হয়। বাংলা ভাষায় সচিত্র সাপ্তাহিক নারী সাময়িকী বেগম পত্রিকায় নিয়মিত গল্প লিখতেন তিনি। গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্মৃতিকথা মিলিয়ে তার এ-যাবৎ প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ছয়টি।

একটি সাক্ষাৎকারে দেশে থাকার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিদেশে ফ্রি মেডিকেল সেবাসহ নানা সুযোগ-সুবিধা পাওয়া গেলেও নিজের দেশের জন্যে খারাপ লাগত। সন্তানদের জন্যে মায়া হতো। তাই কষ্ট হলেও দেশে থাকার সিদ্ধান্ত আমি নিয়েছি।

সর্বজনশ্রদ্ধেয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব দিলারা জামান পারিবারিক জীবনেও একজন সফল মানুষ। ১৯৬৪ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রসাশন বিভাগের পরিচালক ও বাংলা একাডেমির পুরস্কারপ্রাপ্ত কথাসাহিত্যিক ফখরুজ্জামান চৌধুরীর সঙ্গে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের দুই কন্যা তানিয়া আক্তার ও যুরায়রা প্রবাসী।

আবুল হায়াত

১৯৪৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে জন্মগ্রহণ করেন আবুল হায়াত। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তার পরিবার পাড়ি জমায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের চট্টগ্রামে। মা মরহুমা শামসুন্নাহার বেগম ও বাবা মরহুম এম এ সালাম। রেলওয়ে কর্মকর্তা বাবার হাত ধরে বিভিন্ন নাটকের আসরে যেতে যেতে শৈশবেই নাটকের প্রতি তৈরি হয় তার প্রগাঢ় ভালবাসা। মাত্র ১০ বছর বয়সেই মঞ্চে প্রথমবারের মতো ‘টিপু সুলতান’ নাটকে অভিনয় করেন তিনি।

চট্টগ্রামেই স্কুল ও কলেজ জীবন শেষে ১৯৬২ সালে বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হন আবুল হায়াত। ১৯৬৭ সালে স্নাতক সম্পন্ন করে তিনি যোগ দেন সরকারি চাকরিতে, ঢাকা ওয়াসার প্রকৌশলী হিসেবে। একই বছর ইডিপাস নাটকের মধ্য দিয়ে আবুল হায়াতের টেলিভিশনে পদার্পণ। অভিনয়ের প্রতি ভালবাসা ও এক্ষেত্রে সহজাত পারদর্শিতার ফলে পরবর্তীতে মঞ্চ ও টিভি মিলিয়ে হাজারেরও বেশি নাটকে অভিনয় করেন তিনি। অভিনয়ের পাশাপাশি নাট্যকার ও নাট্যনির্দেশক হিসেবেও তিনি প্রশংসিত।

আমাদের দেশে হাতেগোনা যে কজন সৃজনশীল অভিনেতার অবদানে স্বাধীনতার পর টিভি নাটকের আধুনিকায়ন সম্ভব হয়েছিল, আবুল হায়াত তাদের অন্যতম। তিনি বাংলাদেশের জনপ্রিয় মঞ্চ নাট্যগোষ্ঠী নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও সহসভাপতি। মঞ্চ ও টেলিভিশনের পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে বড় পর্দায়ও দেখা গেছে তার স্বচ্ছন্দ পদচারণা। বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ও পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের তিতাস একটি নদীর নাম-এ অভিনয়ের মাধ্যমে তার চলচ্চিত্রে আগমন। এরপর আগুনের পরশমণি, জয়যাত্রা, দারুচিনি দ্বীপ, অজ্ঞাতনামা-সহ আলোচিত ও ভিন্নধর্মী নানা চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয় করেন।

অভিনয়ের পাশাপাশি লেখালেখিতেও তিনি সিদ্ধহস্ত। নব্বইয়ের দশকে পাক্ষিক তারকালোকে প্রকাশিত তার নিয়মিত কলাম ‘আমার কথা’ ও ‘ফুটনোট’ এবং পরবর্তীতে দৈনিক প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘এসো নীপবনে’ পেয়েছে দারুণ পাঠকপ্রিয়তা। নাটক ও সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সাবলীল ভাষা ও সূক্ষ্ম হাস্যরস সহযোগে এবং আলাপচারিতার ঢঙে রচিত তার কলামগুলো পরবর্তীতে বই আকারে সংকলিত হয়। যার মধ্যে এ-বছর প্রকাশিত ‘জীবনখাতার ফুটনোট’ বইটি উল্লেখযোগ্য। গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস মিলিয়ে তার এ-যাবৎ প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ২৬।

একটি সাক্ষাৎকারে তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন--‘সৃজনশীলতা শিল্পের মূল শক্তি। এবং শিল্পী হতে হলে এই সৃজনশীলতার চর্চা প্রয়োজন। শুধু তারকা হওয়াই যার উদ্দেশ্য, সে কখনো শিল্পী হয়ে ওঠে না। বরং যে শিল্পী বিনয়ী এবং শেখার কোনো সুযোগ হাতছাড়া করেন না, তিনি আজ হোক কাল হোক তারকা হবেনই।’ মননশীল এ শিল্পীর জীবন যেন তার এ চিন্তাচেতনারই প্রতিচ্ছবি।

সর্বজনশ্রদ্ধেয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আবুল হায়াত পারিবারিক জীবনেও একজন সফল মানুষ। ১৯৭০ সালে মাহফুজা খাতুন শিরিনের সঙ্গে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের দুই কন্যা বিপাশা হায়াত ও নাতাশা হায়াত এদেশের সংস্কৃতি জগতের প্রিয়মুখ।

বহুমাত্রিক ও শক্তিমান এ অভিনেতা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার, শেলটেক পদক, বাংলাদেশ টেলিভিশন সুবর্ণ জয়ন্তী পদকসহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ২০১৫ সালে পেয়েছেন সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা একুশে পদক।

দেখুন আরো ভিডিও

image

আমি কিছু করতে চাই—মোশাররফ করিম

১০ নভেম্বর ২০২১

image

বাবার মতো রাগী হতে চাওয়াটা ছিল ভুল!—অভিনেত্রী আজমেরি হক বাঁধন

২১ সেপ্টেম্বর ২০২১

image

সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোয়ান্টাম মেথড মেডিটেশন চালু করা উচিত- সুজিত মোস্তফা, ৩৩৪ ব্যাচ

১১ আগস্ট ২০২০

image

আমি এখন স্থির হতে শিখেছি—ফারাহ আলম, ৩৩৬ ব্যাচ

২৫ জুন ২০২০

image

ডিপ্রেশন কাটাতে সহায়তা করে মেডিটেশন—বাপ্পি চৌধুরী, ৪৬৫ ব্যাচ

১১ ফেব্রুয়ারি ২০২০

image

এখানে এসে বুঝলাম! আসলেই সম্ভব- নির্ঝর চৌধুরী, ৪৬৩ ব্যাচ

২৩ নভেম্বর ২০১৯

image

প্রথম পরীক্ষায় পাশ করলাম—আনিসুর রহমান মিলন, ৩৪৩ ব্যাচ

২৬ আগস্ট ২০১৯

image

শুকরিয়া আদায় করতে শিখেছি- লুসি তৃপ্তি গমেজ, ৩৪৭ ব্যাচ

২০ আগস্ট ২০১৯